এপার বাংলার ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এবার ওপার বাংলাতেও।

Advertisement

কাঁটাতারের বেড়া এপার বাংলার ওপার বাংলাকে আলাদা করে দিলেও দুই বাংলার আবেগ, সংস্কৃতি এবং নাড়ির টানকে ছিন্ন করতে পারেনি। আজ তাই এপার বাংলা ওপার বাংলার আলাদা হওয়ার কাহিনী আর দুই দেশের মানুষের ছিন্নমূল হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলি আজও বাংলা সাহিত্যে ফুটে ওঠে। বাংলা ভাগের ঘটনা যেন এখনো দুই বাংলার মানুষের মনে চিরসবুজ এক ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে। আর তাই বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রান্নাবান্না এবং এক ছিন্নমূল হয়ে আসা নারীর জীবন সংগ্রামের গল্প নিয়েই কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার গল্প, নিজের বাড়িতে আর কখনো না ফেরার গল্প, তৎকালীন সময়ে বাঙালি নারীর অসহায়তার গল্প সমস্ত হারিয়ে খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার গল্প আর তারপর ধীরে ধীরে উন্নতি শিখরে পৌঁছানো, এক এক করে মানুষ হারানো এবং এক নতুন যুগ শুরু হওয়ার গল্প সমস্তই ফুটে উঠেছে ইন্দুবালার এক একটি রান্নার গল্পের মধ্যে দিয়ে। আর তাই লেখা ইন্দুবালা ভাতের হোটেল শুধুমাত্র গল্প নয়, বাঙালির অতীত স্মৃতি যা কখনো ভোলা সম্ভব নয়।

তবে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের গল্পটি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতের বাঙালি পাঠকের মধ্যে এতটাই সাড়া ফেলেছে যে উপন্যাসটি অবলম্বনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল ওয়েব সিরিজও তৈরি করা হয়েছে। আর উপন্যাস এবং ওয়েব সিরিজের হাত ধরে ইন্দুবালা হাতের হোটেল এসে পৌঁছেছে ওপার বাংলা তথা বাংলাদেশেও। উপন্যাসের ইন্দুবালা তার বাড়ি ফিরতে চাইলেও জীবনের টানাপোড়েনে ফিরতে পারেননি বাংলাদেশে। সেই স্বপ্নকে সত্যি করে বাংলাদেশের মাটিতে এবারে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল স্থাপন করা হয়েছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, পাবনা সদর উপজেলার জালালপুর এলাকায় ঢাকা-পাবনা মহাসড়কের পাশেই দেখা মিলবে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের। হোটেলের মুখেই দেখা মিলবে সকালের খাবার এবং দুপুরের খাবারের মেনু লেখা বোর্ডের। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার খাবারের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসা বেশ কিছু দুর্মূল্য খাবারের নাম মিলবে এই বোর্ডে, আর সেগুলি আপনারা এই হোটেলে অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যেই পেয়ে যাবেন।

Advertisement

আরেকটু এগিয়ে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে ঢুকলেই দেখা মিলবে ঘরোয়া পরিবেশে লাল শাড়ি পরে গ্রাহকদের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত মহিলাদের। তবে শুধু রান্নাতেই বাঙালিয়ানার ছোঁয়া নেই, পরিবেশনেও রয়েছে একশো ভাগ বাঙালিয়ানা। বাংলার আদি সংস্কৃতি অনুসারে কলাপাতায় পরিবেশন করা হয় খাবার। বিগত ১৯ শে মে ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশের পাবনা সদর উপজেলায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের শুভ উদ্বোধন করা হয়। আর তারপর থেকেই সংবাদমাধ্যমে একাধিক বার ভাইরাল হয়েছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের নানা ধরনের ভিডিও এবং ছবি। কল্লোল লাহিড়ীর লেখা উপন্যাস ইন্দুবালা ভাতের হোটেল পড়ে এবং ওয়েব সিরিজ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই এই হোটেলটি শুরু করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সোহানী হোসেন, এমনটাই জানা গিয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে। সোহানী হোসেন আরো জানিয়েছেন যে, নারকেল দিয়ে কচু বাটা, কুমড়োর ছককা, সোনামুগের ডাল, আম দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল, কচু ঘণ্টো, চিংড়ি ভর্তা, আম দিয়ে ডাল সহ নানা ধরনের বাঙালি খাবার যেগুলি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে চলেছে সেগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তার এই ছোট্ট উদ্যোগ।

আরও পড়ুন:- বাড়িতে বসেই মাত্র কয়েক মিনিটে স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের জন্য আবেদন করুন। রইলো বিস্তারিত পদ্ধতি।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সংবাদমাধ্যমে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে ইন্দুবালা ভারতের হোটেল। আর তাই পাবনার সদর উপজেলার এই হোটেলের খাবার খাওয়ার জন্য পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বাগেরহাট সহ বিভিন্ন জেলার মানুষ বারংবার ছুটে এসেছেন। তবে প্রত্যেকদিন হোটেলে যথেষ্ট মানুষের ভিড় হওয়া সত্ত্বেও সিরিয়াল ধরেই প্রত্যেককে খাবার দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যান্য হোটেলের তুলনায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে সাশ্রয়ী মূল্যে যথেষ্ট ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়, আর তাই বারংবার এখানেই ছুটে আসেন বলে জানিয়েছেন শহরের মেস এবং হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রীরা। এমনকি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রী সহ শিক্ষকরাও বাদ পড়েননি ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে গ্রাহকের তালিকা থেকে। সংবাদ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের খাবারের স্বাদ নিতে এবং হোটেলটিকে এক ঝলক দেখতে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এমনকি ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের গ্রাহকের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নামও।

Advertisement

বইয়ের পাতার ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বাস্তবে উঠে এসেছে এটা দেখে অবাক তো হতেই হয়। কিন্তু বর্তমানে যেখানে দুই বাংলাতেই বড় বড় ফাইভ স্টার হোটেল এবং বার্গার, পিৎজা সহ অন্যান্য বিদেশী খাবারের ভিড়ে বাঙালিয়ানা প্রায় হারাতে বসেছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল তাদের বাঙালিয়ানার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই যে ইন্দুবালা হোটেল জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাংলাদেশের ইন্দুবালা ভাতের হোটেল রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। আর তাতেই আরো একবার দুই বাংলার নারীর টান সমগ্র বিশ্বের সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। এপার বাংলা হোক বা ওপার বাংলা কাঁটাতারের দুই দিকের মানুষের কাছে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এবং সোহানী হোসেনের এই শুভ উদ্যোগ বারংবার প্রশংসিত হয়েছে। উভয় বাংলাতেই যেখানে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া হারাতে বসেছে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মফস্বল, পুরনো বাড়ি, বাড়ি ঘেঁষে থাকা একফালি বাগান, পুকুর এবং অজস্র স্মৃতি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল যেন বাঙালিয়ানার এক জ্বলজ্বলে নজির হয়ে দুই বাংলার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।